বাবা “ছায়াটা এখন আমার”
রায়হান তখন সদ্য অনার্স শেষ করেছে। শহরের কলেজ থেকে ফলাফল হাতে পেয়েই বাবাকে ফোন করেছিল,
“বাবা, ফার্স্ট ক্লাস পেলাম!”
ওপাশ থেকে বাবার গলা — গর্বে টইটম্বুর,
“জানতাম তুই পারবি, বাবা।”
সেই ফোনটাই ছিল শেষ কথা।
দু’দিন পর হঠাৎ হাই প্রেশারে স্ট্রোক করে বাবার মৃত্যু হয়।
রায়হানের চোখের সামনে যেন গোটা পৃথিবীটা থেমে গেল। বাবা, যে মানুষটা জীবনভর সাইকেল চালিয়ে বাজার করেছেন, নুনে-তেলে সংসার টেনেছেন, সেই মানুষটা এমন হঠাৎ করে চলে যেতে পারে — এটা কিছুতেই মানতে পারছিল না।
বাবা ছিলেন তিন ভাইবোনের একমাত্র ভরসা। মা অসুস্থ, ছোট বোন তখনো স্কুলে পড়ে, আর ভাইটা একদম ছোট। রায়হান ভেবেছিল বাবার মৃত্যুর পর হয়তো দুই-এক মাস সময় পাবে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার। কিন্তু সময় কোনো অবকাশ দেয়নি।
২. দায়িত্বের শুরু
শেষকৃত্য শেষ হতেই আত্মীয়-স্বজনরা নিজেদের জীবনে ফিরে গেল। রায়হান বুঝে গেল — এখন থেকে ওকেই হতে হবে পরিবারের নতুন “বাবা”।
প্রথম কাজ, বাবার রেখে যাওয়া হিসাবগুলো দেখা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সামান্য কিছু সঞ্চয়, কয়েকটা ঋণ, আর ছোট্ট একটা বাড়ি। ভাঙা চালার নিচে বসে রায়হান বাবার পুরনো ডায়েরি হাতে নিল। সেখানে লেখা ছিল—
“রায়হানকে মানুষ করাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন। আমি জানি, একদিন এই ছেলেটাই আমার জায়গা নেবে।”
চোখের পানি পড়ে গেল ডায়েরির পাতায়। রায়হান বুঝল, এই জায়গাটা কেবল উত্তরাধিকার না, এটা একটা যুদ্ধের ব্যাটন — এখন সে-ই সৈনিক।
৩. সংগ্রামের দিনগুলো
রায়হান নিজের পড়া থামিয়ে চাকরি খুঁজতে লাগল। প্রথমে একজন প্রাইভেট শিক্ষকের কাজ নিল। দিন শেষে রাত জেগে অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং শিখল, যাতে একটু বেশি রোজগার করা যায়।
মা ভোরে উঠে রান্না করেন, আর রায়হান ছোট ভাইকে স্কুলে পাঠিয়ে নিজে ছুটে যায় কাজে। ছোট বোনের কলেজে ভর্তি, ফি জোগাড় করতে গিয়ে নিজের মোবাইলটাও বিক্রি করে দিল। অনেক রাত পর্যন্ত শুধু হিসাব করে যায় — কোন টাকা কোথায় যাবে, কীভাবে আগামী মাস চলবে।
৪. মানুষের মতো মানুষ
রায়হান নিজে খুব সহজ জীবন বেছে নিল। নতুন পোশাক নেই, বন্ধুদের আড্ডা নেই, কেবল একটাই লক্ষ্য —
“বাবার স্বপ্নটা যেন কোনোভাবে থেমে না যায়।”
গ্রামের লোকজন একসময় বলত —
“বাবার মতো ছেলেটাও সত্যিকারের মানুষ হইছে।”
রায়হান ধীরে ধীরে মা-বোন-ভাইকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দিল। ছোট ভাই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, বোন পড়ছে নার্সিং-এ। মা এখনো রাতে বাবার ছবির সামনে বসে বলে,
“রায়হান আজ কী রান্না খাবে, বলে দে তোর আব্বারে…”
আর রায়হান চুপচাপ পাশে বসে। বাবার পছন্দের খাবারগুলো এখন আর নিজের জন্য নয় — পরিবারের মুখে হাসি দেখলেই সে নিজেকে সফল মনে করে।
৫. আজকের দিন
আজ রায়হান শহরের এক ভালো কোম্পানির চাকরি করে, সংসারটা গোছানো, ভাই-বোন প্রতিষ্ঠিত। বাবা নেই, কিন্তু তার রেখে যাওয়া মূল্যবোধ, শিক্ষা, আর সাহস — প্রতিদিন রায়হানকে আগলে রাখে।
প্রতিবার আয়নায় নিজেকে দেখলে রায়হান মনে মনে বলে,
“ছায়াটা এখন আমার, কিন্তু শক্তিটা এখনো তোমার।”
একদম অনেকটা আমার গল্পেরমত।
উত্তরমুছুন