ছায়ার মতো একজন

পৃথিবীর প্রথম শব্দ হয়তো 'মা' কিন্তু জীবনের প্রথম নিরাপদ ছায়া 'বাবা'। প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বিশ্বের বহু দেশে পালিত হয় ‘বিশ্ব বাবা দিবস’। কিন্তু এই দিবস কেবল একটি ক্যালেন্ডারের তারিখ নয়-এটি একজন পুরুষের নিঃশব্দ ত্যাগ, দায়িত্ববোধ, নির্ভরতার গভীর স্বীকৃতি। ২০২৫ সালে, ১৫ জুন বিশ্ব বাবা দিবস পালিত হচ্ছে। এ দিনে আমরা স্মরণ করি সেইসব মানুষদের, যাঁরা সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়তে নিজের বর্তমান বিলিয়ে দেন, যাঁদের হাত ধরেই সন্তানের আত্মবিশ্বাস জন্ম নেয়। বিশ্ব বাবা দিবসের সূচনা হয় যুক্তরাষ্ট্রে। ওয়াশিংটনের সোনারা স্মার্ট ডড নামের এক নারী ১৯১০ সালে প্রথমবার এই দিবস পালনের উদ্যোগ নেন। তিনি চেয়েছিলেন, যেমন মায়েদের জন্য মা দিবস রয়েছে, বাবাদের জন্যও একটি দিন থাকুক-যাঁরা নিঃস্বার্থভাবে সন্তানদের বড় করেন। তাঁর বাবা উইলিয়াম স্মার্ট একজন একক পিতা ছিলেন, যিনি মায়ের মৃত্যু পর সন্তানদের লালনপালন করেন। সেই ভালোবাসা থেকেই জন্ম নেয় বাবা দিবস। ১৯৭২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন জুন মাসের তৃতীয় রবিবারকে Father’s Day হিসেবে জাতীয় স্বীকৃতি দেন। পরবর্তীতে এটি বিশ্বব্যাপী পালিত হতে থাকে। আমরা “বাবা” শব্দটি শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে এক কঠোর মুখ-যিনি সকালে বেরিয়ে যান, রাতে ঘরে ফেরেন। কিন্তু সেই মুখেই লুকিয়ে থাকে হাজারো ভালোবাসা, ব্যথা, স্বপ্ন আর আত্মত্যাগ। বাবা হয়তো সন্তানের জন্য গল্প বলেন না, কিন্তু তার জীবনের প্রতিটি কাজ নিজেই এক নিঃশব্দ গল্প। তিনি হাসেন না, কিন্তু সন্তানকে হাসিয়ে তোলেন। তিনি কাঁদেন না, কারণ কাঁদলে ভেঙে যাবে সেই আশ্রয়ের দেয়াল। আজকের সমাজে পিতৃত্ব বদলেছে। এখন বাবা মানে শুধু উপার্জনকারী নন-তিনি সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য, শিক্ষাগত দিক, এমনকি দৈনন্দিন যত্নেও সরাসরি যুক্ত থাকেন। নারী-পুরুষ সমান অংশীদারিত্বের যুগে বাবার ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ। কাজের জায়গা, সংসার, সামাজিক দায়িত্ব-সব জায়গায় তাঁরা এখন শুধু “প্রোভাইডার” নন, “পার্টনার”। অনেক বাবা এখন সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যান, খেলা শেখান, রান্না করেন, গল্প পড়েন। আধুনিক বাবা মানেই একজন মাল্টিটাস্কিং নায়ক। বাবা দিবসে ফেসবুকে ছবি দেওয়া, উপহার দেওয়া এসব অনেকেই করেন। তবে এর বাইরেও এক জিনিস খুব দরকার-উপলব্ধি। যে বাবা হয়তো আপনাকে কোনোদিন “ভালোবাসি” বলেননি, তিনিই হয়তো ভোর ৬টায় ঘুম থেকে উঠে অফিস যান, রাতে ফিরেও আপনার জন্য ফল নিয়ে আসেন। যে বাবা আপনাকে নিজের পছন্দের খেলনা কিনে দেননি, তিনিই হয়তো সেদিন বাজারের শেষ টাকা আপনার স্কুল ফিসে খরচ করেছিলেন। আজকের দিনে আপনি যদি বাবা হয়ে থাকেন, সন্তানের চোখে নিজেকে কেমন বাবা হিসেবে দেখতে চান-তা-ও ভেবে নেওয়ার সময় এসেছে। বাংলাদেশে পিতৃত্বের ধারণা ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। শহরের বাবারা এখন সন্তানের শিক্ষা ও মানসিক বিকাশে সরাসরি যুক্ত। অনেক গ্রামীণ পরিবারেও বাবা এখন শুধু রুটি রুজির মানুষ নন-তিনি স্নেহের ছায়াও হয়ে উঠছেন। তবে এখনো অনেক বাবা নিজেদের অনুভব প্রকাশে অনীহা বা সংকোচবোধ করেন। এ ব্যবধান দূর করতে চাই যত্ন,সচেতনতা ও পারস্পরিক বোঝাপড়া। বাবা আসলে সেই ছায়া, যাঁকে আমরা সবসময় পাশে পাই-তবু অনুভব করতে শিখি একটু দেরিতে। তিনি হয়তো কাঁধে করে নিয়ে যান না আজকাল, কিন্তু জীবনটাকেই কাঁধে বয়ে চলেছেন নীরবে। বিশ্ব বাবা দিবসে, একবার শুধু বলুন- “বাবা, আমি তোমার ঋণ শোধ করতে পারবো না, কিন্তু তোমার পাশে থাকতে চাই-একজন সন্তান হয়ে।” আজকের দিনে- বাবাকে সময় দিন। একটি চিঠি লিখুন তাঁকে। তাকে জড়িয়ে বলুন- "আমি তোমাকে ভালোবাসি, বাবা।"

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমি একজন ব্যর্থ মা!!

"মা দিবস" সন্তানের কাছে মা-ই হলেন জগতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি

বাবা “ছায়াটা এখন আমার”